Logo
সংবাদ শিরোনাম :
ভানুবিলের কৃতিপুরুষ জননেতা হিজম ইরাবতের ১২৭ তম জন্মবার্ষিকী পালিত কমলগঞ্জে জাতীয় কন্যা শিশু দিবস পালিত কমলগঞ্জে বিশ্ব পর্যটন দিবস পালিত  অনৈতিক সম্পর্কের ছবি দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগে কমলগঞ্জে যুবক আটক  কমলগঞ্জে বিভাগীয় কমিশনারের মতবিনিময় সভা কমলগঞ্জে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে মতবিনিময় সভা ফতেপুর ইউনিয়নের সার্ভার হ্যাক করে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন  মৌলভীবাজারের কৃতি সন্তান পরমানু বিজ্ঞানী ড. খলিলুর রহমান আর নেই সৈয়দ শামসুল ইসলাম বাবুর জানাজা সম্পন্ন, বিভিন্ন মহলের শোক প্রকাশ কমলগঞ্জ পৌরসভায় ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্পের ৪৮টি পাইপ গায়েব !

চা জনপদের বসন্ত উৎসব : ফাগুয়ার হোলি খেলা

রিপোটার : / ১৪০ বার দেখা হয়েছে
প্রকাশিত : শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০২২

কমলকন্ঠ ডেস্ক ।। চা বাগান এখন কেমন যেন ফ্যাকাসে। সেই চিরচেনা দৃশ্য, সেই সজীবতার রং সবুজ চা-বাগানে এখন নেই। একেবারেই যে নেই, তা বলা যায় না। বৃষ্টিপ্রধান এই অঞ্চলে প্রতিবছরই তো অক্টোবর থেকে দু-এক পশলা বৃষ্টি হয়। এবারও হয়েছে। তাই কোনো কোনো চা বাগানে হালকা সবুজের ছোঁয়া লেগেছে।

তবে অধিকাংশ বাগানের মাটি এখন নিরস। তাই ‘প্রুনিং’ (গাছের আগা ছেঁটে ফেলা) করা চা-গাছে এখনো খুব একটা প্রাণের সঞ্চার হয়নি, কুঁড়ি গজায়নি। ন্যাড়া মাথার লক্ষ-কোটি চা-গাছ দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি। মাঠের পর মাঠ। বিবর্ণ চা শিল্পাঞ্চলের মানুষগুলো এখন ঠিক এর বিপরীত। তাদের মনে এখন রংধনুর সাতরং ভর করেছে। তারা মেতেছে রঙের উৎসব ফাগুয়ায়।

বেগুনি, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল- কী নেই? যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই সাতরঙের ছড়াছড়ি। নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ সবাই মেতেছে ফাগুয়া উৎসবে। একে অপরের দিকে রং ছুড়ে মারছে, গান গাইছে, নাচছে। তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী এমনকি বয়োবৃদ্ধরাও আনন্দে মেতেছেন। প্রাণের উচ্ছলতায় বয়সের ভেদাভেদ ভুলে গেছেন সবাই। শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা-বাগান ঘুরে দেখা গেল এমনই দৃশ্য।

ভাড়াউড়া চা-বাগানের নাচঘরের সামনে সুধন হাজরা নামের মধ্যবয়সী এক চা শ্রমিকের কাছে এসে দাঁড়ালাম। ভয়ে ছিলাম। এই বুঝি রং-জলের প্রলেপে আমার মানচিত্রটাই না পাল্টে যায়! কিন্তু না! এসবের কিছুই হলো না। লোকটি আমার পূর্বপরিচিত হলেও তাকে চেনার কোনো উপায় ছিল না। সারা শরীর নানা রঙের আবরণে ঢাকা পড়েছে। সুধন জানালেন, বছরে দুটি উৎসবে চা জনগোষ্ঠীর মানুষজন আনন্দের সুযোগ পায়। এক, বাঙালি সনাতন ধর্মের দুর্গোৎসব। দুই, রঙের উৎসব ফাগুয়া।

এ দুটোর মধ্যে ফাগুয়া উৎসবই চা জনগোষ্ঠীর প্রধান উৎসব। ফাগুয়া উৎসব শুরু হয়েছে আজ শুক্রবার (১৮ মার্চ)। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের দোলপূর্ণিমা তিথিতে এ উৎসব শুরু হয়। উৎসব উপলক্ষে চা বাগানে ছুটি থাকে। চা-বাগানে এ উৎসবের রেশ থাকবে আগামী ৭-৮ দিন পর্যন্ত।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে দুর্গাপূজার সাতদিন প্রতিটি চা-বাগানে যাত্রাপালার আসর বসতো। এখন সেই আসর হয় না। অনুমতি পাওয়া যায় না বলে। আবার কারো কারো অভিযোগ, এসব আসরের আড়ালে জুয়া খেলার বিস্তার ঘটে । 

থাক, এই দিকে আজ আর নাইবা হাটলাম। ফাগুয়া উৎসবের কথাই বলি। ছন্দ-তাল-লয়হীন চা-জনগোষ্ঠীর কঠিনতম জীবনে মহানন্দের জোয়ার নিয়ে এসেছে ফাগুয়া উৎসব। সেই জোয়ার ছড়িয়ে পড়েছে চা-বাগানের আনাচ-কানাচে। চারিদিকে শুধুই রঙের ছড়াছড়ি। ছোপ ছোপ রঙের দাগ লেগে আছে চা বাগানের অলিগলিতে, শ্রমিক লাইনে, বাড়িঘরের আঙিনায়। ভাড়াউড়া চা-বাগানের তরুণেরা নাচের দল নিয়ে বেরিয়েছে শ্রমিক লাইনে। তারা পরিবেশন করছে চা জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী কাঠিনৃত্য। তাদের এই পরিবেশনা বাড়তি আনন্দ জোগাচ্ছে। মাদলের তালের সঙ্গে পাহাড়ি গানের সুর মিলে সৃষ্টি করেছে এক অন্যরকম আবহ, মাধুর্য। নিজের অজান্তেই যেন বুঁদ হয়ে যাওয়া যায় এক অন্যরকম শৈল্পিক নেশায়।

হরি, ফাগু, বিষন, বিধু, সুখুদের নয়-দশ জনের নাচের দল। শ্রমিক লাইন ছাড়াও তারা তাদের পরিবেশনা নিয়ে বাবুদের (চা বাগানের স্টাফ) বাসায়, ব্যবস্থাপকের বাংলোয় যাচ্ছে। নাচের দলের দলনেতা বিষন। তিনি জানালেন, তারা আগামী সাতদিন চা বাগানে নেচে-গেয়ে আনন্দ বিলাবেন।

তার সঙ্গে কথা বলে আরোও জানা গেল, ফাগুয়া উৎসবকে সামনে রেখে দল গঠনের জন্য তারা মাসখানেক আগে থেকে মহড়া দেন। যারা ভালো নাচতে গাইতে পারে, বাজাতে পারে তাদের নিয়ে দল গঠন করা হয়। একেকটি চা-বাগানে এমন দুই-তিনটি দলও হয়। তাদের মধ্যে আবার ভেতরে ভেতরে প্রতিযোগিতাও চলে।

ভাড়াউড়া পেরিয়ে ভুড়ভুড়িয়া চা বাগানে পৌঁছাতেই কানে বাজলো পাহাড়িয়া মাদলের সুর। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পথ ধরে কিছু দূর এগিয়ে কাকিয়াছড়া চা বাগানে গিয়েও চোখে পড়লো একই দৃশ্য। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, মধ্যবয়সী সবাই নাচছে- গাইছে- আনন্দ করছে। চা শ্রমিক নেতা কালীঘাট ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান পরাগ বাড়ই বলেন, শত দুঃখ-কষ্ট, শত অভাব-অনটনের মধ্যেও উৎসবের কয়েকটি দিন তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে আনন্দে কাটানোর চেষ্টা করেন। শ্রমিকেরা এই আনন্দ ভাগাভাগি করেন প্রতিবেশীদের সঙ্গে। দূর-দূরান্তের চা-বাগান থেকে মেয়েরা নাইওর আসে জামাইসহ।

কাকিয়াছড়া চা বাগানে দেখা হয় ববি রিকিয়াসনের সংগে। ববি আমার পূর্ব-পরিচিত। বিদ্যাবিল চা-বাগান থেকে কাকিয়াছড়া চা-বাগানে বাপের বাড়ি নাইওর এসেছে ববি। শুধু ববিই না। ববি’র মতো অধিকাংশ চা-বাগানের ঘরে নাইওরিরা এসেছে ফাগুয়া উৎসবকে উপলক্ষ্য করে। চা-শ্রমিক বাবারা উৎসব উপলক্ষ্যে। 

সামর্থ অনুযায়ী ভালো খাবারের ব্যবস্থা করছেন। নতুন কাপড় উপহার দিচ্ছেন মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনিকে। জামাইরাও দিচ্ছেন শ্বশুর-শাশুড়িকে। এটাই নাকি চা-জনগোষ্ঠীর মানুষের শত বছরের প্রথা। ভাবতে ভালো লাগে, ফাগুয়া উৎসবে নাইওর এসে ববিরা তাদের পরিচিত সেই পাহাড়ি ছড়ায় অবগাহন করে, কৈশোরের ফেলে যাওয়া খেলার সাথিদের সঙ্গে প্রাণে প্রাণ মেলায়।

চা-বাগানের ছায়াবৃক্ষের মগডালে সবুজ ঘুঘুদের ডানা ঝাপটানোর মতোই উচ্ছলতায় মেতে ওঠে। সারা দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর চা-শ্রমিকেরা যে পারিশ্রমিক পায়, তা দিয়ে পরিবারের সবার দুবেলা আহার যোগানোই যেখানে কষ্টকর, সেখানেও এই দুঃসহ সীমাবদ্ধ জীবনের আঙিনায় রংধনুর সাতরঙ উঁকি দেয়, আনন্দের ছোঁয়া লাগে বছরের অন্তত এই কয়েকটা দিনে।


আরো সংবাদ পড়ুন...
Developed By Radwan Ahmed