Logo

আজ পৌষ পার্বণ : বাঙালী সংস্কৃতির বিশেষ উৎসব

রিপোটার : / ৩০৬ বার দেখা হয়েছে
প্রকাশিত : বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০২২

image_pdfimage_print

বিশ্বজিৎ রায় ।। আজ পৌষ পার্বণ। বাঙালি সংস্কৃতির একটি বিশেষ উৎসবের দিন। প্রতিবছর বাংলা পৌষ মাসের শেষ দিনে আয়োজন করা হয় এ উৎসবের। এর মাধ্যমে আমরা পৌষ মাসকে বিদায় জানাই ও মাঘ মাসকে আলিঙ্গন করি। একে আবার অনেকে ‘মকর সংক্রান্তি’ও বলে থাকেন।

সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্তি’ মূলত জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি ক্ষণ বা সময়। এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়ে থাকে। এই সময়ে সূর্য তার নিজ কক্ষপথ থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে তাই এর নাম মকর সংক্রান্তি। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে, ১২টি রাশি অনুযায়ী এরকম সর্বমোট ১২টি সংক্রান্তি রয়েছে।

পৌষ পার্বণ আবহমানকাল ধরে গ্রামীণ লোকসমাজে চর্চা হওয়া বাঙালী সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই এই দিনটির ধর্মীয় গুরুত্ব ছাড়াও সামাজিক, ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়। প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতেও এই দিনের তাৎপর্য সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। প্রতিবছর আমাদের দেশেএই দিনকে ঘিরে যেমন নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্টান পালিত হয় তেমনি আয়োজন করা বিভিন্ন ধরণের সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্টানেরও।

https://www.sunnews24x7.com/storage/news/4.3_1579167576.jpg

১সপ্তাহ আগে থেকেই শুরু হয় প্রস্তুতি। বাংলার বধূরা তৈরী করেন নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন নকশা ও সুস্বাদু পিঠা। সংক্রান্তির দিনে এই পিঠা-পুলি, পায়েস, দই-চিড়া, তিলু-কদমা আর নকুল-বাতাসার পাশাপাশি এই উৎসবের অন্যতম উপাদেয় খাবার গুড় দিয়ে তৈরি তিলের লাড্ডু আর চোঙা পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে। সনাতন হিন্দু স¤প্রদায়ের প্রতিটি বাড়িতে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও প্রতিবেশীর বাড়ি গিয়ে পিঠা-পুলি খাওয়া আর কিশোররা ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেন।

বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে পৌষ সংক্রান্তি সংরাইন নামে পরিচিত। পৌষ সংক্রান্তিতে সিলেটিদের বিশেষ খাবার আইটেমটি হলো চোঙ্গা পিঠা। যা বাঁশের চোঙার ভেতর চাল ব্যবহার করে তৈরী করা এক বিশেষ ধরণের খাদ্য। চোঙ্গা পিঠা তৈরীতে ব্যবহার করা হয় বিরণী ধানের চাল। যে বাঁশের চোঙায় রান্নার কাজটি হয় সেটিও বিশেষ প্রজাতির বাঁশ। পাহাড়ের ঘন জঙ্গল আর চা বাগানের আশপাশের উঁচু টিলা জমিতে জন্ম নেয়া স্থানীয়ভাবে ডলু বা কালী নামে পরিচিত এই বাঁশ চা শ্রমিকরা সংগ্রহ করে বাজারে এনে বিক্রি করেন। একটি আখি রেখে অন্য আখির কাছাকাছি আড়াআড়ি ভাবে কাটা

পিঠা তৈরির এই বাঁশের ভেতরে পরিমান মতো চাল ও পানি ঢুকিয়ে চোঙার মুখটি খড় দিয়ে ভালোভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর সেটা বিশেষ ব্যবস্থায় খড়ের বা কাঠের আগুনে পোড়ানো হয়। চাল ঠিকমতো সেদ্ধ হয়ে গেলে চোঙাটি বের করে ঠান্ডা করা হয়। তারপর বাঁশের পাতলা বাকলটি ছাড়িয়ে পিঠা বের করার পর তা খাবারের জন্য পরিবেশন করা হয় আখের রস, গুড়, মধু, দুধ,রান্না সব্জি ইত্যাদি দিয়ে। চুঙ্গা পিঠার বিশেষত্ব: হচ্ছে এই খাবারটি সহজে নষ্ট হয় না, দীর্ঘদিন সংরক্ষন করে রাখা যায়। সিলেট অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে একসময় বড় মাছের ভাজার সঙ্গে চুঙ্গা পিঠা ছিল উৎসব-আমেজের খাবার। কিন্তু সময়ের আবর্তে আজ তা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।

https://i.ytimg.com/vi/H8hk4yIyTJE/maxresdefault.jpg

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও তার আশপাশের সনাতন ধর্মাবলম্বিদের কাছে মকর সংক্রান্তি মূলত একটি শস্যোৎসব। সাড়ম্বরে পালিত হওয়া এই উৎসবটি  স্থানীয়ভাবে আউনি বাউনি (বানানান্তরে আওনি বাওনি) বা আগলওয়া উৎসব নামে পরিচিত। এটি ক্ষেতের পাকা ধান প্রথম ঘরে তোলা উপলক্ষ্যে কৃষক পরিবারে পালনীয় একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। হেমন্তকালে আমন ধান ঘরে প্রথম তোলার প্রতীক হিসেবে পৌষ সংক্রান্তির দিন কয়েকটি পাকা ধানের শিষ ঘরে এনে একত্রে লম্বা করে বিনুনি পাকিয়ে তার সঙ্গে মুলোর ফুল, সরষে-ফুল, আমপাতা ইত্যাদি গেঁথে ‘আউনি বাউনি’ তৈরি করা হয়। এই আউনি বাউনি ধানের গোলা, ঢেঁকি, বাক্স-পেটরা-তোরঙ্গ ইত্যাদির উপর এবং খড়ের চালে গুঁজে দেওয়া হয়। বছরের প্রথম ফসলকে অতিপবিত্র ও সৌভাগ্যদায়ক মনে করেন সেখানকার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তারা একটি পবিত্র ঘটে সারা বছর ধরে সংরক্ষণ করা হয় এই ‘আউনি বাউনি’কে।

নতুন ফসলের উৎসব ছাড়াও ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই মকর সংক্রান্তিকে অশুভ সময়ের শেষ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। পঞ্জিকা মতে, জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পড়ে এই দিন। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত বাংলা দিনপঞ্জির সাথে সনাতন ধর্মাবলম্বিদের পঞ্জিকার ব্যবধান দু’দিনের। তাই পৌষ সংক্রান্তি হয় দেশের প্রচলিত বাংলা দিনপঞ্জির মাঘ মাসের ২ তারিখ।

ধর্মীয় গুরুত্বের জন্য এই দিনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্নস্থানে বিভিন্ন স্থানে দিবসটিতে পূল্য¯œান ও বিরাট মেলা অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীর সমাগম হয় এসব মেলায়। মেলায় বিভিন্ন ধরনের খাবার এবং অন্যান্য উপহার কেনা বেচা ছাড়াও এছাড়াও অয়োজন করা হয় পালা গান, বাউল গানসহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।

https://encrypted-tbn0.gstatic.com/images?q=tbn:ANd9GcSKFF47M6D3acrscHkZf99TlLU6YyqW0nO83QoiO3g33BR5XU6C1facRCOl51WtMee4DMo&usqp=CAU

কোথাও কোথাও আয়োজন করা হয় দিনব্যাপী ঘুড়ি উৎসবের। প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণকারীরা আগে থেকে ঘুড়ি বানিয়ে এবং সুতায় মাঞ্জা দিয়ে প্রস্তুুুতি সম্পন্ন করে রাখেন। সারাদিন ঘুড়ি উড়ানোর পরে সন্ধ্যায় পটকা ফুটিয়ে ফানুস উড়িয়ে উৎসবের সমাপ্তি করে অনেকে। প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব বাংলাদেশে মুঘল আমল থেকে পালিত হয়ে আসা এই কিশোরদের ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা সিলেট অঞ্চলে এখন আর একটা দেখা যায় না।

পশ্চিম ভারতীয় প্রদেশ গুজরাটে এই ‘মকর সংক্রান্তি’ উৎসবটি পালিত হয় ভিন্ন আঙ্গিকে। সেখানকার লোকজন তাদের প্রিয় দেবতা  সূর্য্য দেবের কাছে নিজেদের ইচ্ছা বা আকুতিকে সুন্দর সুন্দর ঘুড়ির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পালন করে ঘুড়ি উৎসব, যা মূলত প্রিয় দেবতার কাছে পৌঁছানোর জন্য একটি রূপক বা প্রতীক হিসেবে কাজ করে। কিছু কিছু এলাকায় মকরসংক্রান্তি সম্মান, অভিলাষ এবং জ্ঞানের দেবী সরস্বতীকে সম্মান প্রদানের মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়। আবার মধ্যভারতের কোন কোন এলাকায় গবাদিপশুকে নানা রঙে সজ্জিত  করে আগুনের ওপর দিয়ে ঝাঁপ দেওয়ানোর মাধ্যমে পালিত হয়। গ্রামগঞ্জে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে থাকে মোরগের লড়াই।

ভারত ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষতঃ দক্ষিণ এশিয়ায় এই দিবস বা ক্ষণকে ঘিরে উদযাপিত হয় উৎসব। নেপালে এই দিবসটি মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়নমারে থিং ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে উদযাপিত হয়। অবশ্য  দেশ ভেদে এর নামের মতোই উৎসবের ধরণেও রয়েছে পার্থক্য। ছবিঃ ইন্টারনেট ।।


আরো সংবাদ পড়ুন...

আর্কাইভ

Developed By Radwan Ahmed