কমলকন্ঠ রিপোর্ট ।।
দেশীয় মাছের অভয়াশ্রম হিসাবে খ্যাত মৌলভীবাজারের হাইল হাওরের বিলগুলো ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ছোট বড় মিলিয়ে এই হাওরের ১৩১টি বিলের অর্ধেকই এখন ভুমি খেকোদের দখলে । একের পর এক বিলকে ঘিরে গড়ে উঠছে ব্যক্তিগত ফিসারী । আর এতে করে একদিকে যেমন বেকার হচ্ছেন এসব বিলের উপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবিরা । অন্যদিকে সীমিত হয়ে পড়ছে দেশীয় প্রজাতির মাছের স্বাভাবিক প্রজননস্থল ।
ভুমি খেকোরা হাইল হাওরের চইড়া বিল দখল করে ফিসারী করেছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি কয়েকজন প্রকৃতি প্রেমী ও গণমাধ্যমকর্মী সরেজমিনে হাওর এলাকায় যান। সেখানে হাওর পাড়ের বাসিন্দা পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকার বাসিন্দা রুকাম মিয়া, জুয়েল মিয়া, আকাশ মিয়াসহ বেশ কয়েকজন জেলের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন চইড়া বিলে এখন আর সেই প্রাকৃতিক পরিবেশ নেই। সেখানে এখন প্রভাবশালীরা তৈরী করেছে হাইব্রীড মাছের খামার।
কথা হয় চইড়া বিলের ইজারাদার পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকার বাসিন্দা ৩নং শ্রীমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আনার মিয়ার সাথে । সাংবাদিকদের সাখে আলাপচারিতায় তিনি জানালেন, লাভের আশায় সরকারকে রাজস্ব দিয়ে দুই বছর আগে তাদের সমিতির নামে চইড়া বিল লিজ নিয়ে ছিলেন । বিলে এসে তিনি দেখতে পান তার একই গ্রামের সফাত মিয়া লীজকৃত বিলের ৯০ ভাগ জমি দখল করে তার উপর গড়ে তুলেছেন বিশাল ফিসারী। প্রতিবাদ করতে গিয়ে নাকি তিনি হুমকীর শিকার হয়েছেন।
চইড়া বিলে সদ্যস্থাপিত এই ফিসারীতে গিয়ে ফিসারীর পরিচালক সফাত মিয়াকে পাওয়া না গেলেও
সেখানে কথা হয় সফাত মিয়ার চাচাতো ভাই দিলু মিয়ার সাথে।
দিলু মিয়া জানালেন, তারা ভুমিহীনের জমি ক্রয় করে এই ফিসারী করেছেন। পরে আনার মিয়ার মাধ্যমে জানতে পারেন এটি চইড়া বিলের লিজের জায়গা । তখন তারা গ্রামের জনৈক মুকিত মিয়ার মারফতে আনার মিয়াকে কিছু টাকা দিয়েছেন। তবে আনার মিয়া বলেছেন, তাকে কোন টাকা দেয়া হয়নি । এরা মিথ্যা বিলাপ করছে। তিনি প্রশাসনের দ্বারস্থ হবেন।
সরজমিনে দেখা যায়, চইড়া বিলের উপর ফিসারীর পাড়ে বেশ বড় বড় বৃক্ষ চারা। বেশ কয়েকটি টংঘর। এসেছে বিদ্যুৎও। নিমিষেই পরিবর্তন হয়ে গেছে চইড়া বিলের দৃশ্যপট। অথছ দু‘বছর আগেও বর্ষায় এই চইড়া বিলের ভাসান পানিতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন অসংখ্য জেলে।
আলাপকালে পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকার সুন্নত মিয়া নামে এক মৎস্যজীবি ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, প্রভাবশালীরা অন্যায়ভাবে সরকারী জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে ফিসারী করার কারনে হাওর এলাকা সংকুচিত হয়েছে। এর ফলে এই বিলে থাকা দেশীয় মাছের স্বাভাবিক বংশবিস্তার তো বাধা গ্রস্থ হচ্ছেই পাপশাপাশি বিলুপ্ত হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতীর জলজ উদ্ভিদ যা এই এলাকার কৃষকরা গবাধি পশুর খাবার হিসেবে সংগ্রহ করতেন। তার মতে, শুধু চইড়া বিলে নয় হাওরের অধিকাংশ বিলেরেই এখন এই চিত্র। হাওরের খাস জমি সরকার ভুমিহীনদের বন্দোবস্ত দিলেও ভুমিহীন সেখানে যেতে পারেনা।
ভূমিখেকোরদল ভুমিহীনের কাগজ সংগ্রহ করে তাদের সাথে দেখা করে কৌশলে তাদের কাছ থেকে জমিগুলো নিয়ে নেয়। পরে এর আশেপাশের খাস জমিগুলো তাদের আয়ত্বে নিয়ে গড়ে তোলে ফিসারী । একই কথা জানান, নৌকার মাঝি সুইলপুরের সুলেমান মিয়া, পশ্চিম ভাড়াউড়া মুমিন মিয়া প্রমুখ ।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ দপ্তর সম্পাদক মামুন আহমদ জানান, এই হাওরের হাজার হাজার একর বিলের জমি দখল করে ফিসারী করেছেন রাগব বোয়ালেরা। এরা এখন সমাজের মাথা।
এ ব্যাপারে কথা হয় শ্রীমঙ্গল উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সহিদুর রহমান সিদ্দিকির সাথে তিনি জানান, হাইল হাওরের আয়তন ১৪ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় পড়েছে ১০ হাজার হেক্টর। এর ভিতরে বিল রয়েছে ৫৯টি যার মধ্যে ২০ একরে নিচে ৩৯টি এবং ২০টি ২০ একরের উপরে। যা থেকে উপজেলার মাছের চাহিদা পুরণ হয়ে থাকে। তিনি জানান, এই বিলগুলো হাওরের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অনেকের ব্যক্তিগত জমির সাথে খাস ভুমিও পড়েছে। ভুমি দখলদারের কবলে পড়ে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বিল সম্পূর্ন রূপে বিলিন হয়েগেছে। অনেকগুলো বিলের জমি অল্প অল্প দখল আছে। এই হাওরে এসে মিশেছে অর্ধশত ছড়া যা গোফলা নদীতে পড়েছে । অনেকে সেই ছড়া গুলোও দখল করে নেওয়ার কারণে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ পরিবর্তন হচ্ছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছেন হাওরের বোরো চাষীরাও। তার মতে, এই হাওরের বিলে প্রায় শত প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে প্রায় ৩০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এ ব্যপারে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ জানান, হাইল হাওরের মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় পড়েছে ৪ হাজার হেক্টর জলাভুমি। যার মধ্যে বিল রয়েছে ৫৫টি। এর মধ্যে ১০/১২টি নি:শেষ হয়ে গেছে।
এ ব্যাপারে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন বালিশিরা পাহাড় রক্ষা সোসাইটির চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন আহমদ জানান, ‘দেশীয় মাছ রক্ষা করি সমৃদ্ধ দেশ গড়ি’ প্রধানমন্ত্রীর এই শ্লোগানকে বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের হাওর ও উন্মুক্ত জলাশয়কে রক্ষা করতে হবে। জলাভুমি দখল করে ফিসারী তৈরী করা এই রাঘব বোয়ালদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। একই সাথে হাইল হাওরে জমির শ্রেণী পরিবর্তন করা শতভাগ বন্ধ করতে হবে। তা না হলে সামনে বড় রকমের বিপর্যয় আসবে।
প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর এলাকা জুড়ে অবস্থিত হাইল হাওর। এখানে রয়েছে মাছর অভয়াশ্রম বাইক্কা বিলসহ প্রায় ১১৪টির মতো বিল। কিন্তু আজ অধিকাংশ বিলেরই অস্তিত্ব নেই। এতে শংকায় পরিবেশ প্রেমীরা।
পরিবেশবিদ সিতেশ রঞ্জন দেব জানান, পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে এখনই হাইল হাওরের বিলগুলো খনন করা প্রয়োজন। প্রত্যেকটি পাহাড়ী ছড়ার নিচের অংশ খনন করে গোফলা পর্যন্ত পানি চলাচলের পথ পরিস্কার করতে হবে।
পরিবেশবাদী সংগঠন পাহাড় রক্ষা সোসাইটির সাথে সম্পৃক্ত সাংবাদিক মোনায়েম খান বলেন, দখলদারদের উচ্ছেদ করে বিলকে বিলে রুপান্তরিত করতে হবে। এরা যতবড় ক্ষমতাধরই হোক না কেন জমির শ্রেণী পরিবর্তন করলে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
এ ব্যাপারে মৎস্যজীবি পশ্চিম ভাড়াউড়া এলাকার মুমিন মিয়া জানান, হাইল হাওরের চার পাশে প্রায় ১০ হাজারেরও অধিক জেলে পরিবারের বসবাস। যেখানে জনসংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। ইতিমধ্যে অর্ধেকের জীবিকা পরিবর্তন হয়েছে। আর পেশা ছাড়ার অপেক্ষায় আছেন বর্তমানে আরো কয়েক হাজার।
এদিকে ফিসারীজের কারনে বন্ধ হচ্ছে বিভিন্ন ছড়ার পানি প্রবাহের পথ। পর্যটকরা বঞ্চিত হচ্ছেন উন্মুক্ত জলাশয়ে ঘুড়ে বেড়ানোর সুযোগ থেকে। ফিসারীর কারনে হাওরের যে অল্প জায়গা ভাসান থাকে সেখানে শহরের ময়লা আবর্জনায় ভর পুর থাকে ।
এ ব্যপারে হাইল হাওরে নিয়ে কাজ করা সিএনআর এস এর সাইট অফিসার মনিরুজ্জামান বলেন, তাদের অনুসন্ধানে তারা হাইল হাওরে ১৩১টি বিলের অস্তিত্ব খোঁজে পেয়েছেন। এর মধ্যে ১০১টি বিল ইজারার রেকর্ড রয়েছে। ৩০টি বিলের কোন হদিস নেই। যে গুলো আছে সেগুলোরও অধিকাংশ দখলে। এই দখল দৌরত্বে হাওরের এখন এমন অবস্থা যে, বর্তমানে বিশাল হাওরে গরু চরানোর জন্যও একটু খালী জমি নেই। নেই গরু রাখার বাথান। এক সময় খাস জায়গায় কৃষকরা দলবদ্ধ ভাবে ধান মাড়াই করতেন এখন সে সুযোগটিও নেই। সবই দখলে।
শ্রীমঙ্গলের পরিবেশ চিন্তাবিদ শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক দ্বিপেন্দ্র ভট্টাচার্য্য জানান, এই হাইল হাওর একসময় এতো গভীর ছিলো এর উপর দিয়ে স্টিমার চলতো। এতদাঞ্চলের চলাচলের মাধ্যমই ছিলো এই হাওর। শ্রীমঙ্গল শহরতলীর উত্তর ভাড়াউড়ার হাওর অভিমুখে জেটি ছিলো। এখনো সেই জেটির নামে শহরে জেটি রোড বিদ্যমান আছে। তিনি জানান, এখন হাওর ছোট হতে হতে দ্বারে এসে লেগেছে। যে হাওরের সীমানা কয়েক বছর আগেও ছিলো প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর এখন এর পরিমান ৭ হাজার হেক্টরেরও কম হবে বলে তাঁর ধারণা।
তবে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, দখলদারদের উচ্ছেদ করে তা আবার বিলে রুপান্তরিত করা হবে এবং যারা সরকারী জমি দখল করবেন তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই তারা আইনানুগ ব্যবস্থা নিবেন।
এব্যাপারে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানান, তিনি এ জেলায় নতুন এসেছেন। তবে ইতিমধ্যেই তিনি অবগত হয়েছেন এটি একটি বৈচিত্রময় জেলা। যেখারে রয়েছে হাওর, পাহাড়, সমতল ভুমি, নদী ও প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র। এ জেলার বৈশিষ্টই হলো এর প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র। আর এটি যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে এ জেলা তার ঐতিহ্য হারাবে। তাই এ জেলা রক্ষায় জেলাবাসীকে সচেতন হওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, হাইল হাওরের ভরাট হওয়া বিলগুলো খননের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরে আনবেন।
হাইল হাওরের পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারী জমি দখল মুক্ত করন ও এর শ্রেণী পরিবর্তনকারীদের কঠোর আইনের আওতায় আনার দাবী প্রকৃতি প্রেমীদের।